ইতিহাসে সভ্যতা, শিক্ষা, সংষ্কৃতি ও শিল্প ভাষ্কর্যের গৌরবের জাজ্বল্যমান সাক্ষ্যি হয়ে যে কয়টি পুরাতাত্মিক নিদর্শন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে তাদের মধ্যে পাহাড়পুর বিহার অন্যতম। ইউনেস্কো ঘোষিত তালিকায় এই পাহাড়পুর বিহারকে ৩২২তম বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে (২-৬) ডিসেম্বর ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐহিত্য রক্ষা কমিটির এক সমাবেশে এই বিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যের গৌরব প্রদান করা হয়। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যতগুলো পুরাকীর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে, পাহাড়পুরের গঠন শৈলী তাদের মধ্যে অন্যতম সেরাদের একটি। সেই সুবাদে পর্যটনে বাংলাদেশে দেশী বিদেশী ভ্রমণ বিলাসী মানুষের কাছে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণের মূর্ত প্রতীক রূপে অবর্তীণ হয় পাহাড়পুর। পালবংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকে এই বিহার তৈরি করছিলেন। এই বিহার বাংলায় পাল রাজত্বের আরেকটি অনন্য বিস্ময়কর কীর্তি।
পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে যা দেখতে পাবেন
🌳 কেন্দ্রীয় মন্দির :
বিহারের অন্তর্বর্তী স্থানের উন্মুক্ত চত্বরের মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে কেন্দ্রীয় মন্দিরের ধ্বংশাবশেষ। বিস্ময়কর মূল মন্দিরটি স্থাপত্য শিল্পের অনুপম নিদর্শন। অসাধারণ এর শৈল্পিক পরিকল্পনা। মন্দিরের দেয়াল জুড়ে পাওয়া যায় প্রায় ২ হাজারটি অপূর্ব পোড়ামাটির ফলকচিত্র। এতে বিচ্ছুরিত হয়েছে প্রাচীণ বাংলার সাধারণ জনজীবনের প্রত্যাহিক প্রতিচ্ছবি। যেমনঃ মানুষ, শিকারি, নৃত্যরত রমণী, রাখাল, গাছপালা, ফুল, পশু-পাখি, হাতি, ঘোড়া আরো কত কি। চারিদেকে তাকালে চোখে পড়ে নান্দনিক শিল্প সুষমার সমাহার।
🌳 গন্ধেশ্বরী মন্দির :
স্নানঘাট থেকে ১২ মি পশ্চিমে পূর্বমুখী প্রাচীরের বাইরে একটি মন্দির আছে। মন্দিরের দক্ষিন দেয়ালে বৌদ্ধদেবী পদ্মপাণির মূর্তি আছে। এটিকে স্থানীয় ভাবে বলা হয় গন্ধেশ্বরীর মন্দির। এর দৈর্ঘ্য ৬.৭মি ও প্রস্থ ৩.৫মি। এর সম্মুখ দেয়ালের ইটে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মসহ বিভিন্ন ধরনের ফুলের নকশা এবং গাঁথুনিতে ব্যবহৃত উপাদান দেখে মনে হয়। এতে একটি চতুষ্কোণ হলঘর রয়েছে। হলঘরের মধ্যবর্তী স্থানে অষ্টকোণাকৃতি একটি স্তম্ভের নিম্নাংশ পাওয়া যায়। পশ্চিমের উদগত একটি দেয়ালের বাইরের দিকে ১.৪মি বাহু বিশিষ্ট বর্গাকার একটি পূজার কক্ষ রয়েছে। তাছাড়া হলঘরের চারটি কুলুঙ্গিতেও মূর্তি স্থাপনের ব্যবস্থা আছে।মন্দিরের সামনে একটি চত্বর আছে। এর মেঝে খাড়া ভাবে স্থাপিত ইট দিয়ে গাঁথা এবং গাঁথুনি পাহাড়পুরের অন্যান্য স্থাপত্য-নিদর্শন থেকে পৃথক।
🌳 উন্মুক্ত অঙ্গন :
বিহারের মধ্যবর্তী উন্মুক্ত অঙ্গনে আরও কিছু ইমারতের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ভোজনশালা ও রন্ধনশালা অবস্থিত। এ দুটি স্থাপনার মাঝে ৪৬মি দীর্ঘ ইট বাঁধানো একটি নর্দমা আছে এবং এর কাছে এক সারিতে তিনটি কূপ আছে। এছাড়াও রয়েছে কিছু নিবেদন স্তূপ, প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় মন্দিরের প্রতিকৃতি ইত্যাদি। নিবেদন স্তূপগুলোর মাঝে দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত স্তূপটি ১৬ কোণ বিশিষ্ট নক্ষত্র আকৃতির। অনুচ্চ একটি মঞ্চের মাঝে সংস্থাপিত এ স্তূপটির সংলগ্ন স্থানে রয়েছে একটি পাকা কূপ। এ ছাড়া বিক্ষিপ্ত ভাবে পাওয়া যায় প্রশাসনিক ভবন, রান্না ঘর, ভোজন শালা, নিবেদন স্তুপ, কুয়ো ইত্যাদি।
🌳 সন্ধ্যাবতীর ঘাট :
বিহারের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে প্রাচীরের বাইরে শানবাঁধানো ঘাট আছে। এটাকে সন্ধ্যাবতীর ঘাট বলা হয়। রাজা মৈদলনের কন্যা সন্ধ্যাবতী এ ঘাটে নিয়মিত স্নান করতেন। বিহারের পাশ দিয়েই একটি নদী প্রবাহিত ছিল। এর দুপাশে প্রতিটি দেয়াল ১.৫মি প্রশস্ত। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ঘাটটি ঢালু হয়ে প্রায় ১২মি নিচে নেমে গিয়েছে।
🌳 সত্যপীরের ভিটা :
সত্যপীরের ভিটা পাহাড়পুর বিহার থেকে ৩৬৫ মিটার পূর্বে অবস্থিত। এ ভিটায় একটি তারা মন্দির এবং বিভিন্ন আকার ও আয়তনের প্রচুর নিবেদন স্তূপের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। মন্দির অঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০টি পোড়ামাটির ফলক, আটহাত বিশিষ্ট দেবীমূর্তি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ লিপি খোদিত পোড়ামাটির গোল সীলগুলি থেকেই এই ভিটা ও তারা মন্দিরের অভিন্নতা প্রতিপন্ন হয়েছে। মন্দির এলাকায় ১৩২টি নিবেদন স্তূপ আছে। মন্দিরের চতুর্দিকে বিভিন্ন আকৃতির ও নকশার নিবেদন সূতপের সংখ্যাধিক্য এবং অলংকরণ এর খ্যাতি ও গুরুত্বের প্রতি সাক্ষ্য দেয়। এখানকার স্তূপগুলির মধ্যে প্রধান মন্দিরের কাছাকাছি অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত চতুষ্কোণ স্তূপটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই সূতপের প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য ৩ মি এবং বহির্ভাগের সূতপটি অলংকৃত ইট দিয়ে শোভিত। খননের ফলে এই সূতপের মধ্যস্থলে ১ মি বর্গ বিশিষ্ট একটি বাঁধানো স্মারক-কুঠুরি আবিষ্কৃত হয়েছে। কুঠুরিটি কয়েক হাজার ছোট ছোট মাটির নিবেদন সূতপের প্রতিকৃতি দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল। মনে হয় মন্দিরে আগত হাজার হাজার তীর্থযাত্রী তাদের ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীকস্বরূপ এগুলি স্মারক কুঠুরিতে উৎসর্গ করতেন।
🌳 কিভাবে যাবেন?
দেশের যেকোন প্রান্ত হতে নওগাঁ শহরে এসে নওগাঁ বালুডাংগা বাস টার্মিনাল হতে সরাসরি বাসযোগে ঐতিহাসিক পাহাড়পুরে যাওয়া যায়। আনুমানিক দূরত্ব আনুমানিক ৩২ কিঃমিঃ এবং বাসভাড়া- ৩০- ৪০ টাকা। অথবা দেশের যেকোন প্রান্ত হতে জয়পুরহাট শহরে এসে বাস অথবা অটোরিক্সা নিয়ে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার চলে আসতে পারবেন। জয়পুরহাট হতে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের দূরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার।
🌳 কোথায় থাকবেন?
পাহাড়পুরে রাতে থাকা তেমন ভাল কোনও আবাসন ব্যবস্থা নেই। তবে নওগাঁ জেলায় অবস্থিত হোটেল প্লাবন, হোটেল যমুনা, হোটেল অবকাশ, মল্লিকা ইন, হোটেল ফারিয়াল ও হোটেল রাজ প্রভৃতি আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারবেন।
🌳 কোথায় খাবেন?
নওগাঁর গোস্তহাটির মোড়ে ভালমানের কিছু খাবারের হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আছে।