পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা হলো রাজশাহী। আম, জাম, লিচু ও রেশমী বস্ত্রের জন্যে বিখ্যাত রাজশাহী জেলা রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় শহর, এই শহর কে বলা হয় এশিয়ার সব চাইতে পরিষ্কার শহর। ।
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সমৃদ্ধ এই রাজশাহী শহরে রয়েছে মনোরম প্রাকৃতিক জায়গা যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এর মধ্যে রয়েছে বাঘা মসজিদ, পুঠিয়া রাজবাড়ি,
পদ্মার পাড়, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শিশু পার্ক, হাওয়াখানা, পদ্মা গার্ডেন, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি।
🏡পুটিয়া জমিদার বাড়ি:
রাজশাহীর প্রাচীন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন পুঠিয়া রাজবাড়ী (Puthia Rajbari)। এটিকে পাঁচআনি জমিদারবাড়ী বলা হয়। মহারানী হেমন্তকুমারী দেবী ১৮৯৫ সালে ইন্দো ইউরোপীয় নকশার আদলে আয়তাকার দোতলা এ বর্তমান রাজবাড়ীটি নির্মাণ করেন। পুঠিয়া রাজবাড়ী পরিবেষ্টিত পরিখাগুলোর রয়েছে আলাদা আলাদা নাম। শিব সরোবর বা শিবসাগর, মরাচৌকি, বেকিচৌকি, গোপালচৌকি ও গোবিন্দ সরোবর পরিখা ছাড়াও রাজবাড়ীতে শ্যামসাগর নামে একটি বিশাল পুকুর রয়েছে। দুটি প্রাসাদ এবং জমিদারদের নির্মিত বেশ কয়েকটি মন্দির এখনো এখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।এদের মধ্যে অন্যতম দোচালা পদ্ধতিতে নির্মিত বড় আহ্নিক মন্দির, ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত বড় শিব মন্দির বা ভূবনেশ্বর মন্দির, চারতলা বিশিষ্ট পুঠিয়া দোল মন্দির এবং পুঠিয়া পাঁচআনী জমিদার বাড়ীর প্রাঙ্গনে অবস্থিত গোবিন্দ মন্দির। পুঠিয়া রাজবাড়ি প্রতিদিন সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
🕌বাঘা মসজিদ:
রাজশাহী শহরে ঐতিহাসিক বাঘা মসজিদ অবস্থিত। লাল ইট দিয়ে তৈরি প্রাচীন এই মসজিদটিতে ১৪ টি গম্বুজ রয়েছে।বাঘা মসজিদের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর পোড়া মাটির ফলক দেখা যায়। মসজিদের পূর্ব পাশের ৫ টি দরজা ছাড়া উত্তর-দক্ষিণের দেয়ালের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাঘা মসজিদের ভেতরে এবং বাইরে প্রচুর পোড়া মাটিরফলক দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের ভেতরে উঁচু স্থানে একটি বিশেষ নামাজের কক্ষ রয়েছে যেটা কার বা কাদের জন্য সংরক্ষিত ছিল তা এখনো অজানা। এ মসজিদের পূর্ব পাশে বিশাল একটি দীঘি এবং অন্য পাশে একটি কবরস্থান রয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের ফলে এই মসজিদের ছাদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের পক্ষ থেকে বাঘা মসজিদের গম্বুজ এবং ছাদ পুনঃনির্মাণ করা হয়।
🏡বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর:
রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর (Varendra Research Museum) হল বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর। আর প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহের তালিকায় বরেন্দ্র জাদুঘর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম। ১৯১০ সালে নাটোরের দিঘাপাতিয়ার জমিদার শরৎ কুমার রায়, আইনজীবী অক্ষয় কুমার মৈত্র এবং রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক রামপ্রসাদ চন্দ্র বাংলার ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের জন্য বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি গঠন করে বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান চালিয়ে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন সংগ্রহ করেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু করে।
বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের অস্তিত্ত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানারকম সংকট দেখা দেয়। ১৯৪৯ থেকে ১৯৬১ সাল পযর্ন্ত বরেন্দ্র জাদুঘরের অর্ধেক অংশ মেডিকেল স্কুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৪ সালে পুনরায় জাদুঘর বন্ধ হবার উপক্রম হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরটি অধিগ্রহণ করে। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ছাড়াও বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর পরিদর্শন করেছেন।
🌳সাফিনা পার্ক:
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার দ্বিগ্রাম খেজুরতলায় প্রায় ৪০ বিঘা জায়গার উপর ২০১২ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছে সাফিনা পার্ক (Safina Park)। গোদাগাড়ী থেকে সাফিনা পার্কের দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। উপজেলার একমাত্র এই বিনোদন কেন্দ্রটি প্রায় ২ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৮ সালে পুনরায় চালু করা হয়। নতুন বিনোদন আয়োজনে সাজানো সাফিনা পার্কটি সব বয়সী দর্শনার্থীদের কাছে চিত্তবিনোদন ও পিকনিক স্পট হিসেবে বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
🌳উৎসব পার্ক:
রাজশাহীর বাঘা উপজেলা থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরে বাঘা দীঘির পাড়ে বিনোদনের ভিন্ন আয়োজন নিয়ে গ্রামীণ শান্ত পরিবেশে উৎসব পার্ক (Utshab Park) গড়ে তোলা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রায় ৮০ বিঘা জায়গা জুড়ে সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে পার্কটি স্থাপন করা হয়। উৎসব পার্ক গ্রামের সহজ সরল মানুষদের জীবনে শহুরে ভাবধারায় বিনোদনের ব্যতিক্রমী মাত্রা যোগ করেছে।
গাছ গাছালির ছায়া ঘেরা মনোরম পরিবেশের উৎসব পার্কের আকর্ষণীয় রাইডের মধ্যে আছে ট্রেন, নাগরদোলা, ঘূর্ণি এবং দোলনা সহ ৮টি ভিন্নধর্মী রাইড, বিভিন্ন পশু পাখির দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য, বসার বেঞ্চ, লেক এবং পিকনিক স্পট। পার্কের লেকের জলে ভেসে বেড়ানোর জন্য রয়েছে প্যাডেল বোটের ব্যবস্থা। ছুটির দিন ছাড়াও অন্যান্য দিনগুলোতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিশু কিশোর ও নানা বয়সী দর্শনার্থীদের পদভারে মুখরিত থাকে চমৎকার এই বিনোদন কেন্দ্রটি।
🐯রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা:
পদ্মার তীর ঘেঁষা এক সময়ের রেসকোর্স ময়দানের ৩২.৭৬ একর জায়গা জুড়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা গড়ে তোলা হয়েছে। রাজশাহী শহর থেকে চিড়িয়াখানার দূরত্ব মাত্র ৪.২ কিলোমিটার। ১৯৭২ সালে শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জাম সড়কের কাছে রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানার নির্মাণ কাজ শুরু হলে ১৯৭৪-৭৬ সালে রাজস্ব বিভাগের অনুমতিক্রমে এখানে চিড়িয়াখানার পাশাপাশি একটি শিশু পার্ক নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হয়। ফলে রাজশাহী কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানাটি শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানা (Shaheed A.H.M. Kamruzzaman Central Park & Zoo) হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
🌳শিশু পার্ক:
রাজশাহী জেলা সদরের নওদাপাড়া বড় বনগ্রামে অবস্থিত শিশু পার্ক রাজশাহী শহরের একটি অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র। নয়নভিরাম পিকনিক স্পট, সব বয়সীদের জন্য দেশি-বিদেশি রাইড, সুবিশাল লেক এবং নৌকা ভ্রমনের সুব্যবস্থা ২০০৬ সালে নির্মিত এই পার্কটিকে শহরবাসীর কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এই শিশু পার্ক শহীদ জিয়া শিশু পার্ক নামে অধিক পরিচিত।
১২.২১ একর জায়গা জুড়ে নির্মিত শহীদ জিয়া শিশু পার্কে আছে মেরী গো রাউন্ড, মিনি রেলকার, ফ্লুম রাইডস, স্কাই বাইক, সুপার সুইং, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, কিডি রাইডস, থ্রিডি মুভি থিয়েটার, পেডেল বোট, প্যারাট্রুপার, টি কাপ, ব্যাটারী কার, বাউন্সি ক্যাসেল, হর্স রাইড, ফ্রগ জাম্প এবং হানি সুইং ইত্যাদি। এছাড়া ১০ বছরের ছোট বাচ্ছাদের জন্য রয়েছে ফ্রি ফিজিক্যাল গেমস্। পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা, ওয়াস রুম এবং কার পাকিংয়ের সু-ব্যবস্থা রয়েছে।